ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কতদিন টিকে থাকতে পারবেন লিজ ট্রাস?

ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দেড় মাস না পেরোতেই মসনদ হারানোর শঙ্কায় পড়েছেন লিজ ট্রাস। শতাধিক ব্রিটিশ আইনপ্রণেতা চলতি সপ্তাহে লিজ ট্রাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টায় নামছেন বলে খবর বের হয়েছে।

আর এর মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে- ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঠিক কতদিন আর টিকে থাকতে পারবেন লিজ ট্রাস?

সোমবার (১৭ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির কিছু এমপি বর্তমান পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে দেওয়ার কাছাকাছি বোধ করছেন। এছাড়া দেশের বাজারে কয়েক সপ্তাহের অশান্তি এবং রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার পর অনেকের মেজাজও বেশ খারাপ।

ব্রিটেনের একজন মন্ত্রী বেশ অযাচিতভাবেই বলছেন, ‘কাজ শেষ… (নির্বাচনে) আমরা জিততে পারব না’। লিজ ট্রাসের ওপর আস্থা রাখা এই মন্ত্রী স্বীকার করছেন, সাধারণ নির্বাচন যখনই অনুষ্ঠিত হোক, তাদের দল আসন হারাবে।

বিবিসি বলছে, গত ৭২ ঘণ্টা ধরে যে বিতর্ক চলছে তা হলো- লিজ ট্রাস ডাউনিং স্ট্রিটে আর কতক্ষণ টিকে থাকতে পারবেন। দেড় মাসেরও কম সময় আগে দায়িত্ব নেওয়া ব্রিটেনের এই প্রধানমন্ত্রীকে তার পদ থেকে সরে যাওয়ার জন্য প্রকাশ্যেই আহ্বান জানিয়েছেন অল্প সংখ্যক কনজারভেটিভ এমপি। তবে ট্রাসকে প্রকাশ্যেই সরে যাওয়ার আহ্বান জানানো দলীয় এই এমপিদের সংখ্যা শিগগিরই আরও বাড়তে পারে।

এছাড়া বিবিসির সাথে কথোপকথনে অন্য অনেকে এটাও যুক্তি দিচ্ছেন, পরবর্তী নির্বাচনের আগেই লিজ ট্রাসকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে চলে যেতে হবে। কেউ কেউ অবশ্য বিশ্বাস করেন, মাস দেড়েক আগে ট্রাস যে পদ পেয়েছেন সেখানে আরও কয়েক মাস তিনি থাকতেও পারেন।

কিন্তু ক্রমেই সংখ্যা বাড়ছে এমন একটি অংশের দাবি, লিজ ট্রাসের আর কয়েক সপ্তাহ বা এমনকি আর হয়েতা কয়েকদিন বাকি আছে। যদিও এটি কীভাবে হবে বা লিজ ট্রাস পদত্যাগ করলে কারা দায়িত্ব নেবে সে সম্পর্কে কোনো স্পষ্টতা নেই।

ব্রিটেনের সাবেক একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী তো লিজ ট্রাসের বিষয়ে সিদ্ধান্তই জানিয়ে দিলেন। তিনি বলছেন: ‘মানুষ জানে যে, এটি শেষ। তবে এটি (লিজ ট্রাসের প্রস্থান) কীভাবে এবং কখন সেটাই এখন প্রশ্ন।’

তবে বিবিসি বলছে, নিজেকে নিয়ে আশা ছাড়ছেন না লিজ ট্রাস। মূলত আশা যে এখনও শেষ হয়ে যায়নি সেটি মন্ত্রী এবং এমপিদের বোঝাতেই সোমবারের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করবেন তিনি।

লিজ ট্রাস পার্লামেন্টে টোরি এমপিদের ১০০ জনের শক্তিশালী ওয়ান নেশন গ্রুপের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন – এবং ক্যাবিনেট মন্ত্রীদের সাথে আলোচনাও করবেন। সেখানে মাঝারি মেয়াদে ভারসাম্য বজায় রাখা সম্পর্কে তাদের মতামত জানতে চাওয়া হবে। এছাড়া অন্যান্য সংসদ সদস্যদেরও কফির জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে কারণ ব্রিটেনের এই প্রধানমন্ত্রী তাদের মনও জয় করতে চাইছেন।

এছাড়া ডাউনিং স্ট্রিট থেকে যে বার্তাটি দেওয়া হচ্ছে তা হলো- তারা এখন সবকিছু শুনছেন। গত শুক্রবার যুক্তরাজ্যের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টকে দেশটির অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন ট্রাস। হান্টের এই নিয়োগ সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ট্রাসকে কিছু সময় পাইয়ে দেবে। কিন্তু সেই সময়টা কি যথেষ্ট হবে?

বিবিসি বলছে, অর্থমন্ত্রী পদে জেরেমি হান্টের নিয়োগে কিছু টোরি এমপি সন্তুষ্ট। সাবেক একজন ব্রিটিশ মন্ত্রী মনে করেন, ‘তিনি (জেরেমি হান্ট) দেশের প্রকৃত প্রধানমন্ত্রী।’

এছাড়া ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির কেন্দ্রে থাকা প্রভাবশালী ব্যক্তিরা গত সপ্তাহান্তে যে যুক্তি-তর্ক নিয়ে কাটিয়েছেন, তা হলো- বিদ্রোহীদের আরও অপেক্ষা করা উচিত এবং তিনি (জেরেমি) তার হ্যালোইন অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় ঠিক কী করছেন তা দেখতে হবে। আর এই কাজে সরকারকে অন্তত এক পাক্ষিক বা ১৪ দিন সময় দেওয়া যেতে পারে।

এছাড়া শক্তিশালী এমন অনেক এমপিও আছেন যারা বেশ মরিয়া হয়েই সবাইকে শান্ত থাকার জন্য আবেদন করছেন। ব্রিটিশ এমপিদের একটি ‘বড় অংশ’ বিদ্যমান পরিস্থিতি কিছুটা ঠান্ডা হতে দিতে চায় বলে জানা গেছে। কেউ কেউ বলছেন, দলের বিভিন্ন শাখায় রদবদলের মাধ্যমে বিভক্তি কাটিয়ে তোলা যেতে পারে।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কর্মসূচির পতন ঘটছেই – কেউ কেউ সতর্ক করেছেন, ব্রিটেনে এই সপ্তাহে আরও অশান্তি দেখা দিতে পারে।

বরিস জনসনের অধীনে কাজ করা ব্রিটেনের সাবেক এজন মন্ত্রী বলেছেন, ‘এর অনেক কিছুই বাজারের ওপর নির্ভর করবে। বাজার পরিস্থিতি এখন যেখানে আছে, যদি সেখানেই থাকে, তাহলে লিজ ট্রাস হয়তো কিছুটা তাকে কিছুটা সময় পাবেন। আর যদি বাজারের পতন অবাধে হতেই থাকে, তবে তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে যেতে হবে।’

গত দিন দু’য়েকের মধ্যে আরও যেসব এমপি বিবিসির সাথে কথা বলেছেন, তাদের মতামতও অনেকটা একই রকম। তবে এর আলাদা বক্তব্য আরও সুনির্দিষ্ট: ‘তিনি (লিজ ট্রাস) শেষ হয়ে গেছেন… আমি আর তার কোনো জায়গাই দেখতে পাচ্ছি না।’

কনজারভেটিভ পাটির অনেকেই এই ধারণা পোষণ করেন। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, পরবর্তীতে যা ঘটবে তাতেও তারা একমত। ব্রিটেনের সাবেক একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রী বলছেন, ‘আমি মনে করি না যে, এই প্রধানমন্ত্রীত্ব আর টিকবে বা কোনো ফল বয়ে আনবে – তবে কীভাবে এর অবসান হবে; তা আমি আপনাকে বলতে পারব না।’

বিবিসি বলছে, বর্তমানে কার্যকর ‘১৯২২ কমিটির’ নিয়ম অনুযায়ী, লিজ ট্রাস এক বছরের জন্য আস্থা ভোটের সম্মুখীন হওয়া থেকে নিরাপদ। এই নিয়ম পরিবর্তন করা যেতে পারে, কিন্তু সাম্প্রতিক নজির অনুযায়ী, কমিটি তা করতে অনিচ্ছুক বলেই মনে হচ্ছে।

মূলত কোনো কিছু করতে বাধ্য করার চেয়ে নিজে থেকে সরে যাওয়াকেই অধিকতর পছন্দের বিকল্প হিসেবে মনে করে ওই কমিটি। বেশ কয়েকটি সূত্র এই সপ্তাহান্তে বিবিসিকে একই ইঙ্গিত দিয়েছে।

আবার অনেক সংসদ সদস্য নেতৃত্ব বেছে নেওয়ার লক্ষ্যে আইনপ্রণেতাদের মধ্যে আরেকটি দীর্ঘ বিতর্কের সম্ভাবনা নিয়ে আতঙ্কিত। ফলস্বরূপ, রাজ্যাভিষেক নিয়ে কথোপকথনের মধ্যেই সংসদ সদস্যরা অন্য আইনপ্রণেতাদের সাথে পরামর্শ ছাড়াই কয়েক দিনের মধ্যে তাদের পরবর্তী নেতা বেছে নেবেন।

সম্ভাব্য নতুন নেতা হিসেবে এই সপ্তাহান্তে ব্যাপকভাবে আলোচিত তিনটি নাম হলো- বেন ওয়ালেস, ঋষি সুনাক এবং পেনি মর্ডান্ট। কিন্তু প্রত্যেকেরই নিজস্ব সমস্যা আছে। ওয়ালেসের সহযোগীরা বলছেন, তিনি এখনই এটা (নেতৃত্ব) চান না; তিনি বিশ্বাস করেন, এখন স্থিতিশীলতার দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত এবং স্থিতিশীলতা অর্জনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে সময় দেওয়া উচিত।

ঋষি সুনাক এখনও ব্যাপকভাবে বিভক্ত এবং বরিস জনসনের পতনের জন্য যারা তাকে দায়ী করে তাদের সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা কম। কেউ কেউ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন যে, যদি সুনাককে সংসদ সদস্যদের নেতা করা হয় তাহলে দলটি ভেঙে যাবে।

অন্যদিকে পেনি মর্ডান্টকে কেউ কেউ নেতৃত্বের বিষয়ে খুব অনভিজ্ঞ বলে মনে করেন, বিশেষ করে অর্থনৈতিক সংকটের সময়ে। এছাড়া আলোচিত অন্য নামগুলোর মধ্যে জেরেমি হান্ট এবং গ্রান্ট শ্যাপসের নামও রয়েছে। কিন্তু তাদের কেউ কি এমন বিভক্ত দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে পারবে?

মূলত ডাউনিং স্ট্রিটের সতর্কতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ আইনপ্রণেতারা এই সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করবেন বলে যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী গণমাধ্যম ডেইলি মেইল ​​জানিয়েছে। এর ফলে ফের সাধারণ নির্বাচনের দিকে যেতে পারে ইউরোপের প্রভাবশালী এই দেশটি।

অজ্ঞাত সূত্রের বরাত দিয়ে ডেইলি মেইল ​​জানিয়েছে, ব্রিটেনের ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির ১০০ জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য (এমপি) লিজ ট্রাসের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে চিঠি জমা দিতে প্রস্তুত। এই চিঠি তারা কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্ব প্রতিযোগিতার আয়োজনকারী কমিটির প্রধান গ্রাহাম ব্র্যাডির কাছে জমা দেবেন।

এমপিরা ব্র্যাডির কাছে ট্রাসকে এটাই বলতে অনুরোধ করবেন যে, ‘তার (ট্রাসের) সময় শেষ’ বা তার নেতৃত্বে অবিলম্বে আস্থা ভোটের অনুমতি দেওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলের নিয়ম পরিবর্তন করতে হবে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গ্রাহাম ব্র্যাডি এই পদক্ষেপে বাধ সাধছেন বলে জানা গেছে। তার যুক্তি, নবনিযুক্ত চ্যান্সেলর অর্থাৎ ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্টের সাথে আগামী ৩১ অক্টোবরের বাজেটে অর্থনৈতিক কৌশল নির্ধারণের সুযোগ পাওয়ার যোগ্য লিজ ট্রাস।

তবে এই সপ্তাহে যাই ঘটুক না কেন, কনজারভেটিভ পার্টি এখন কোনো সুখের জায়গা নয়। বছরের পর বছর অভ্যন্তরীণ বিতর্কের পরও দলটি ক্ষমতা নিয়ে ঠিক কী করতে চায় সে সম্পর্কে এখনও দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।

আর এটিই লিজ ট্রাসের অবস্থানকে অবিশ্বাস্যভাবে অনিশ্চিত করে তুলেছে। একইসঙ্গে এটি অন্যান্য বিকল্পকেও করে তুলেছে কঠিন।

উল্লেখ্য, ব্রিটেন দীর্ঘদিন ধরেই রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত। ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর থেকে এই সংকটের কারণে তিনজন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা হারিয়েছেন।